অনেক্ষন হলো, একটাও গাড়ি পাচ্ছি না। ঝিরিঝিরি ঠান্ডা হাওয়া দেহে যেন সূচের মতো বিধছে। যদিও হালকা সোয়েটার গায়ে আছে। আসলে মিটিং শেষ হতে এতটা লেট হবে বুঝতে পারি নি। মিস্টার হার্ডিন খুব রিকোয়েস্ট করছিল ডিনার পার্টিতে জয়ন করতে। আর না করতে পারলাম না।
হঠাৎ দেখলাম একটা ট্যাক্সি আসছে, দূর থেকেই হাত নাড়ছিলাম। কুয়াশার ভেতর দিয়ে গাড়ির হেডলাইটের আলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। আমার মনে ক্ষানিকটা আশার আলো জেগে উঠলো। মনে মনে বেশ খুশি হয়ে উঠলাম, কারণ এতক্ষন অপেক্ষার পর বাড়ি ফিরতে পারব। আর এগিয়ে গেলাম না, এদিকেই তো আসছে। আমি হাত নাড়তে থাকি। কিন্তু হঠাৎই একটা রাত জাগা পাখি আমার মাথার উপর দিয়ে সশব্দে উড়ে যায়, তার ডানার ঝাপটার শব্দে কিছুটা চমকে উঠলাম আমি। একটু সরে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে যাবো, এমন সময়েই আবিষ্কার করলাম সামনে কোন টেক্সি নেই। তবে কিসের আলো ছিলো! খুব অবাক হলাম। কিছুক্ষন এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার নিস্তব্ধতার মাঝে দাঁড়িয়ে রইলাম। ধরে নিলাম হয়তো চোখের ভুল নয়তো গাড়িটা কোন ভাবে চলে গেছে। রাত ক্রমশ গভীর হতে থাকে।
নাহ! ঠান্ডা বাড়ছে। গায়ে কাপুনি শুরু হয়ে যাচ্ছে। জোসেফকে ফোন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম যদিও নেটওয়ার্ক পাচ্ছিলাম না, বৃথা চেষ্টা।নিরবতার মাঝে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার পেছনে কেমন একটা খচখচ আওয়াজ হচ্ছে। আমার পেছনে ছিল ঘন ঝোপঝাড়। এতক্ষন ভালো করে খেয়াল করিনি। অদ্ভুত একটা আওয়াজ অন্ধকার ঝোপ থেকে আসতে থাকে।হবে হয়তো কোন প্রানী এটা ভেবে ভয় চেপে রাখার চেষ্টা করলাম। আমি ফোনের আলো জ্বালিয়ে পেছনে ঘুরলাম। একগ্রাস ভয় যেন সেই অন্ধকার থেকে চেপে ধরছিল আমায়। আমি তবুও এক পলকে তাকিয়ে থাকি সে দিকে। তেমন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আমি সেইদিকটায় একটু সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেলাম। ফোনের আলো যথেষ্ট ছিল না। একটু ভালো করে দেখার চেষ্টা করছি কিন্তু পেছনে কারো গলার আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠলাম।
“স্যার, কোথায় যাবেন? ”
কিন্তু লোকটির ইংরেজি আমাদের মত অতটাও স্পষ্ট ছিল না। তবুও বুঝে নিলাম।
আবার গম্ভীর কন্ঠে সে বলে উঠলো, উঠে পড়ুন। অদ্ভুত ব্যাপার হল লোকটি কথা বলছে সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে। একটুও নড়াচড়া করছে না। কেন জানিনা ড্রাইভারের আচরণ কিছুটা অদ্ভুত লাগছিল। তাছাড়া তার মুখটাও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিছুটা অদ্ভুত লাগলেও এই সময়ে আর গাড়ি পাব না ভেবে উঠে বসলাম। জানতাম না কতটা বিস্ময় আর ভয় অপেক্ষা করছিল আমার জন্য।
ড্রাইভার সামনের দিকে স্থির দৃষ্টিতে ওই একই ভাবে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে, নাহ কোন হর্নের আওয়াজও হচ্ছে না। গাড়ি চলার সামান্য আওয়াজ হচ্ছে শুধু। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে ড্রাইভার আমায় প্রশ্ন করেন, কোথায় যাবেন?
প্রথমটায় চমকে উঠলাম, মনে পড়লো কিছু না বলেই উঠে পড়েছি। কিন্তু পরে ঠিকানা টা ধীরে ধীরে বললাম। “হুমম ” বলে লোকটি গাড়ি চালানোয় মন দিলো আবার।
গা ছমছমে ব্যাপারটা আবার চলে এলো। গাড়িটা খুব ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলো। বারবার বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, একটু দ্রুত যাবেন প্লিজ, খুব দরকার। কেমন একটা অস্থির লাগছিল। একটু সাহস সঞ্চয় করে কোনভাবে বলেই ফেললাম কথাটা।
লোকটা গাড়ি চালানো বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর জোরে জোরে হাসতে থাকে। শীতল করা সেই হাসি যেন বুকের ভেতরটাও কাপিয়ে দিচ্ছিলো আমার, বড্ড দমবন্ধ লাগছিল।
হাসি থামিয়ে হঠাৎ সে পেছনে ঘুরে তাকায়। গাড়ি চলমান, হাসি থামিয়ে আমাকে শীতল গলায় প্রশ্ন করলেন, একটা গল্প বলতে চাই স্যার, মন দিয়ে শুনবেন।
আমি কাপা গলায় কিছুটা শান্ত হয়ে উত্তর দিলাম, বলুন। ভেবে নিলাম, যাক, গল্প শুনতে শুনতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে পারবো, ভয়ের ব্যাপার টা অন্তত দূর হবে……ড্রাইভার গল্প শুরু করলেন-
“আমি লুমেন। এমনি এক মধ্যরাতের ঘটনা, আমার কাজ থেকে আসতে সেদিন একটু দেরী হয়ে যায়। গাড়ি পাচ্ছিলাম না।
হাইওয়ের রোড ধরে এগিয়ে যাই ট্যাক্সি খুজতে। কিন্তু নাহ! পেলাম না। বেশ খানিকটা চিন্তিত হয়ে সামনে তাকাতেই দেখলাম, দূরে ট্যাক্সির হেডলাইটের স্পষ্ট আলো। আমি কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর দেখতে পেলাম ট্যাক্সি সামনে দাঁড়িয়ে।
বিপদের সময়ে শেষ অব্দি একটা ট্যাক্সি তো এলো, ঠিকানা বলে উঠে বসলাম ট্যাক্সি তে। গাড়ির জানালা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিলো।লক্ষ্য করলাম, পথ ফুরোতেই চাইছে না। বেশ কিছুটা রাস্তা যাওয়ার পর ভাবলাম ড্রাইভারকে তাড়াতাড়ি পৌছানোর কথাটা বলে দিই। বলতে গিয়ে আমার হাত পা যেন অবশ হয়ে আসতে চাইলো, কারণ ড্রাইভারের জায়গা ফাকা ছিল, কেউ নেই!
গাড়ি থেমে নেই, হঠাৎ একসাথে গাড়ির সবগুলো জানালার কাচ একসাথে উপরে উঠে যায়। হাত দিয়ে ক্রমাগত ধাক্কা দিতে লাগলাম, ভয়ে আতংকে গলা দিয়ে আওয়াজ বের হতে চাইলো না। গাড়িতে একা আমি, গাড়ি চলছে….
আমার দমবন্ধ হয়ে আসতে চাইলো, মনে হচ্ছিলো কেউ যেন…..কেউ যেন আমার গলা চেপে ধরেছে, আমি শ্বাস নিতে পারছিলাম না…….কত সময় এভাবে পার করেছিলাম জানিনা…”
এতটুকু বলে ড্রাইভার চুপ করে রইলেন। শীতের রাতেও লোকটির ভয়ংকর বিবরণ শুনে একবার ঘেমে যাচ্ছি আবার একবার গায়ে কাটা দিচ্ছে। আর কোন দিকে হুশ ছিলো না, উৎকন্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কি হলো?…..
“তারপর….. “, ড্রাইভার স্মিত শীতল হাসি তে জবাব দিলো, ” গাড়িটা খুব সম্ভব সামনের ওই গাছটাতে সজোরে ধাক্কা খেয়েছিলো। আর বাড়ি ফেরা হলো না……. ”
এক অসম্ভব স্তব্ধতা ঘিরে ধরলো আমায়, এ কি করে সম্ভব! বাড়ি ফেরা হলো না, এমন একটা অ্যাকসিডেন্ট! তাহলে কি করে..!!…..ভয়ে খুব অস্থির হয়ে পড়লাম। সবকিছু অদ্ভুত লাগলো আমার। এখন একটাই চিন্তা মাথায় ঘুরতে শুরু করলো , যে করেই হোক আমাকে গাড়ি থেকে বের হতে হবে। এদিক সেদিক নড়েচড়ে বসি, গাড়ির দরজায় হাত রাখি। আর কাপা গলায় চিৎকার করে বললাম, গাড়িটা থামান, আমি নামবো!
তবুও গাড়ি থামছে না, অন্ধকার পথ। আবারও বলার জন্য সামনের দিকে একটু ঝুকে পড়লাম। কিন্তু তা আর বলা হয়ে উঠলো না, কারণ গাড়ি চলমান অবস্থায় হলেও সিট ফাকা ছিল…..কোন কিছু পরোয়া না করে সামনের গাছটির দিকে হেডলাইটের নিশ্চল আলো ফেলে ধেয়ে যাচ্ছে গাড়িটা……
সমাপ্ত
Rai Saha